পাই (π) এর ইতিকথা
পাহাড় থেকে নদীর ঢল নেমে আঁকাবাঁকা পথে চলে শেষ পর্যন্ত তার গন্তব্যে গিয়ে ঠেকেছে। সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক দৃশ্য, তবে একজন বিজ্ঞানী এখানেও যেন খুঁজে পায় এই প্রকৃতির অপার রহস্যের নিদর্শন। গবেষণা করে জানা গেছে যে আঁকাবাঁকা পথে চলা নদী পাহাড় থেকে নেমে শেষ পর্যন্ত যে দূরত্ব অতিক্রম করে আর নদীর উৎস থেকে শেষ মাথা পর্যন্ত সরলরৈখিক দূরতের অনুপাতের মান হল পাই (π) এর সমান। এই নদীগুলোর উৎস থেকে এর শেষ গন্তব্য পর্যন্ত যদি সরলরেখা টানা হয় তাহলে যে দূরত্ব পাওয়া যাবে, আর নদীগুলো একেবেকে আসলেই যে দূরত্ব অতিক্রম করে – এই দুই মানের অনুপাত হবে প্রায় ৩.১৪১৬ !
এটিকে অনেকেই কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিবে। তবে π এর প্রতি প্রকৃতির গভীর ভালবাসার প্রমান পাওয়া গেছে অসংখ্যবার। বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতি যেমন বৃত্ত, উপবৃত্ত, কোণ ইত্যাদির ক্ষেত্রফল বা আয়তনে পাওয়া যায় পাই এর উপস্থিতি। পৃথিবীর অভিকর্ষ (Gravity) পরিমাপের অন্যতম পরিচিত উপায় হলো সরল দোলকের দোলনকাল পরিমাপ করা। এখানেও হিসাব করতে গিয়ে এসে গেল π।
দুটো আধান বা চার্জের মাঝে যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল কাজ করে সেখানেও পাওয়া যায় π। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম ভিত্তি হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র। এই সূত্রেও দেখা যায় এই π এর উপস্থিতি। অনিশ্চয়তার সূত্রের মূল কথা হলো কোন কণা ( Particle) এর অবস্থান এবং ভর দুটো একই সাথে নিখুঁতভাবে জানা সম্ভব নয়। পার্টিকেলের ভর যত নিখুঁতভাবে জানা যাবে এর অবস্থান ততই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এমনকি টাইম-স্পেসের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে π। আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকোয়েশনে π কে আবার পাওয়া যায়। এই ফিল্ড ইকোইয়েশনই আপেক্ষিক তত্ত্বের ভিত্তি এবং এই ইকোয়েশন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় কেন পদার্থ (Matter) ও শক্তির প্রভাবে স্পেস-টাইম বেঁকে যায়। মহাবিশ্বের ঘনত্ব পরিমাপের ক্ষেত্রেও π ব্যবহৃত হয়। গণিতের জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতির শ’খানেক সমীকরণ বের করা যাবে যেখানে π রয়েছে।
কিন্তু প্রকৃতির সর্বত্র π এর এমন উপস্থিতির কারণ কি? এটা বোঝার আগে আমাদেরকে বুঝতে হবে পাই (π) আসলে কি। পাই হলো একটি ধ্রুব ( Constant ) যার মান প্রায় ৩.১৪১৫৯২… এটি একটি অমূলদ সংখ্যা অর্থাৎ দশমিকের পর এর সংখ্যা কখনই শেষ হবে না বরং তা চলতেই থাকবে। π এর প্রকৃত পরিচয় হলো এটি বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাত। একটি নিখুঁত বৃত্ত যত ক্ষুদ্র বা বিশালই হোক না কেন এর পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত সর্বদা হবে একটি ধ্রুব সংখ্যা, আর এর ধ্রুব সংখ্যাটিই হলো π। আর এই বৃত্ত ও ব্যাসের মাঝে লুকিয়ে থাকা π নিয়েই এতো মাতামাতি।
পাইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। π এর মান অমূলদ সংখ্যা হওয়ার কারণে দশমিকের পর সংখ্যা শেষ হয় না। শুধু তাই না, দশমিকের পরের সংখ্যাগুলোর মাঝে কোন প্রকার প্যাটার্নও পাওয়া যায়নি আজ অব্দি। আমরা সাধারণত যেসব অমূলদ সংখ্যা চিনি যেমন ৩.৩৩৩৩… এরা দশমিকের পড়ে শেষ না হলেও এদের মাঝে প্যাটার্ন থাকে যা π এর মানের মধ্যে থাকে না। আধুনিক সুপার-কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা π এর ১৩.৩ ট্রিলিয়ন ডিজিটেরও বেশি মান বের করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু তারপরেও π এর দশমিকের পরের সংখ্যাগুলোতে কোন প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেখলে মনে হবে যেন এই সংখ্যাগুলো একেবারেই র্যানডম !
0 Comments:
Post a Comment